কলকাতা, ২০ মে ২০২৫: কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ বাতিল সংক্রান্ত মামলায় রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) কিশোর দত্ত বুধবার জোরালো যুক্তি তুলে ধরে বলেন, “অনিয়ম আর দুর্নীতি এক জিনিস নয়।” তাঁর এই বক্তব্য আসে ২০১৬ সালের ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিলের সিঙ্গল বেঞ্চের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে রাজ্য সরকারের আপিলের প্রেক্ষাপটে। মামলাটির পরবর্তী শুনানি নির্ধারিত হয়েছে ১২ জুন।
এজির যুক্তি: দুর্নীতির প্রমাণ নেই
এজি কিশোর দত্তের মতে, সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ে দুর্নীতির অভিযোগকে “অনুমানভিত্তিক”ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, “দুর্নীতির চিরাচরিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, কে টাকা নিয়েছে তার প্রমাণ দরকার। কিন্তু সিঙ্গল বেঞ্চ কোনো প্রমাণ ছাড়াই শুধু অনিয়মকে দুর্নীতি বলে চালিয়ে দিয়েছে” । এছাড়া, সিঙ্গল বেঞ্চের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (অবসরপ্রাপ্ত) নিজেই মামলার তদন্তে অংশ নিয়েছিলেন বলে এজি অভিযোগ তোলেন। তাঁর ভাষ্য, “সিলেকশন কমিটিতে অভিজ্ঞরা ছিলেন, কিন্তু আদালত বাস্তব প্রক্রিয়ার চেয়ে হাইপথেটিক্যাল বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।”
রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত বলেন, বারবার দুর্নীতি বললেই সেটা যে দুর্নীতি তা প্রমাণিত হয় না। দুর্নীতি বললে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে হবে। যদি দুর্নীতিতে আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে, সেই লেনদেন প্রমাণ করতে হবে। সঙ্গে কোনও পরীক্ষার্থীকে যদি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য ঘুষ নেওয়া হয়েছে সেটিও আদালতে প্রমাণ করতে হবে বলে জোরালো সওয়াল করেন এজি কিশোর দত্ত। তিনি আদালতে আরও জানান, নিয়ম না মানলেই সেটা ‘দুর্নীতি’ নয়। ক্ষমতার অপব্যবহার ‘দুর্নীতি’-র সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না।
সিঙ্গল বেঞ্চের রায় ও স্থগিতাদেশ
২০১৪ সালের টেট পরীক্ষার ভিত্তিতে ২০১৬ সালে এই নিয়োগগুলি সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে দুর্নীতির অভিযোগে ২০২৩ সালের মে মাসে সিঙ্গল বেঞ্চ ৩২ হাজার চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেন। তবে এই রায়কে রাজ্য সরকার ডিভিশন বেঞ্চে চ্যালেঞ্জ করে এবং বিচারপতি সুব্রত তালুকদার ও সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের বেঞ্চ রায়ের উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দেয়। এরপর মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে গেলেও তা ফের হাইকোর্টে ফেরত আসে।
আদালতের প্রশ্ন ও এজির পাল্টা যুক্তি
ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতিরা এজিকে প্রশ্ন তোলেন, “দুর্নীতির অভিযোগ এলে কি শুধু নথি দেখেই রায় দেওয়া যায়?” এজি এর জবাবে বলেন, “সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ে কোনো সরকারি আধিকারিক বা রাজনৈতিক প্রভাবের উল্লেখ নেই। এমনকি অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট না হলেও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, এত বড় সংখ্যক চাকরি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, সিঙ্গল বেঞ্চের বিচারপতি প্রাক্তন পর্ষদ সভাপতিকে এক ঘণ্টার নোটিসে জেরা করলেও অভিযুক্তরা ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন না।
পটভূমি ও পরবর্তী পদক্ষেপ
এই মামলার শিকড় ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগে। অভিযোগ ছিল, টেটের ফলাফল বিকৃত করে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের রায়ের পর রাজ্য সরকার ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করায় শুনানির তারিখ এখন ১২ জুন। এজির যুক্তি ও আদালতের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে, এই বিতর্কিত নিয়োগগুলি স্থায়ী হবে নাকি বাতিলের পথে যাবে।
সংক্ষেপে:
– এজির দাবি: অনিয়ম ≠ দুর্নীতি; সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ে প্রমাণের অভাব।
– আদালতের অবস্থান: ডিভিশন বেঞ্চ রায় মুলতুবি রেখেছে।
– পরবর্তী শুনানি: ১২ জুন।